যৌথবাহিনী, পুলিশ কিংবা গণপিটুনি - শেখ হাসিনার পরে বিচারবহির্ভূত হত্যা যেভাবে ঘটছে

 


যৌথবাহিনী, পুলিশ কিংবা গণপিটুনি - শেখ হাসিনার পরে বিচারবহির্ভূত হত্যা যেভাবে ঘটছে
পেটের দুইপাশে ছোট ছোট ফুটো। কোথাও রক্ত জমাট বাধা। লাল রঙ স্পষ্ট। কোমর, নিতম্ব থেকে হাঁটু পর্যন্ত শরীরের পেছনের অংশ প্রায় পুরোটাই লাঠির আঘাতে কালচে হয়ে গেছে।

ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মৃত ভাইয়ের লাশের এমন ছবিগুলো দেখাচ্ছিলেন সাদিকুর রহমান।

তার ভাইয়ের নাম তৌহিদুল ইসলাম। বাড়ি কুমিল্লা হলেও চাকরিসূত্রে থাকতেন চট্টগ্রামে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে বাবার মৃত্যুতে কুলখানির আয়োজনে এসেছিলেন কুমিল্লায়।

কুলখানির রাতেই যৌথবাহিনীর অভিযানে বাসা থকে আটক হন তিনি।রাত আড়াইটার দিকে সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢোকে। সঙ্গে সিভিল পোশাকেও লোকজন ছিল। আমার ভাইকে খুঁজতে থাকে। আমার ভাই সামনে আসলে বলে অস্ত্র কোথায়? সে নাকি বাসায় অস্ত্র লুকায় রাখছে। আমার ভাই এবং আমরা সবাই বললাম, আমাদের কাছে তো কোনো অস্ত্র নাই।"

ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সাদিকুর রহমান। তিনি জানান, একপর্যায়ে অস্ত্রের খোঁজে তল্লাশি চালায় অভিযানে আসা ব্যক্তিরা। অস্ত্র না পেয়ে পরে তার ভাই তৌহিদুলকে আটক করে নিয়ে যায়।

তিনি বলছিলেন, "ওরা যে নিয়ে গেছে, নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা শুধু পিটাইছে আর পিটাইছে।

সকালে পুলিশ থেকে ফোন করে হাসপাতালে আসতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে দেখি কোনো নড়াচড়া নাই ভাইয়ের। ডাক্তার বললো সে তো আগেই মারা গেছে।"

বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন বন্ধ হবে এমনটাই আশা করেছিলেন অনেকে।

কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার প্রায় ছয় মাস পর এসে দেখা যাচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, এমনকি নিরাপত্তা হেফাজতেও মৃত্যুর মতো ঘটনাও অব্যাহত আছে।

যার সর্বশেষ উদাহরণ কুমিল্লার স্থানীয় যুবদল নেতা তৌহিদুলের যৌথবাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা।

ফলে দেশটিতে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।স্যার', 'আব্বা' ডেকেও রেহাই মেলেনি 'নির্যাতন থেকে'
তৌহিদুলকে যে রাতে আটক করে যৌথবাহিনী, সেই একই রাতে একই গ্রামের লুৎফর নামে আরেকজনকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

চোখ বেঁধে কয়েক ঘণ্টা গাড়িতে রাখার পর ছেড়ে দেয়া হয় তাকে।

লুৎফর জানাচ্ছেন, তার সামনেই লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছিলো তৌহিদুলকে।

"আমাকে চোখ বেঁধে গাড়িতে রেখেছিলো। আর তৌহিদকে গাড়ি থেকে নামিয়ে একটু দূরে নিয়ে পেটানো হচ্ছিলো। আমি তার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। সে শুধু বলছিলো, আমাকে কেন মারছেন। আমি তো কিছু করি নাই।"

লুৎফর বলছেন, তৌহিদুলের কাছে অস্ত্র আছে এমন মর্মে তাকে পেটানো হচ্ছিলো। যৌথবাহিনীর সদস্যরা বলছিলো, অস্ত্র না দিলে আরও মারবে।

"তৌহিদুল ওদেরকে বলছে, ভাই আমার কাছে তো কোনো অস্ত্র নাই। আমি কীভাবে অস্ত্র দেবো। তখন আবার পিটিয়েছে। সে শুধু স্যার, আব্বা–– এরকম কত ডাক যে দিয়েছে, কত কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু নির্যাতন থেকে রেহাই মেলেনি।"

যুবদল নেতা তৌহিদুলের মৃত্যুর ঘটনাটি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পরেছিলো। তার পরিবারের অভিযোগ, প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে কেউ হয়তো যৌথবাহিনীর কাছে 'মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফাঁসিয়েছে'।

তবে তৌহিদুলের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার জানিয়েছেন, এই ঘটনার পর সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আশ্বাস দেয়া হয় তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার।

অন্যদিকে সেনাসদর থেকেও গণমাধ্যমে বিবৃত দিয়ে জানানো হয়, ঘটনার তদন্ত হচ্ছে।

কিন্তু এমন মৃত্যু আর নির্যাতন কী কারণে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তৌহিদুলের স্ত্রী।যৌথবাহিনীর অধীনে' এবং 'গণপিটুনিতে' মৃত্যু বেশি
তৌহিদুলের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনের কারণে। তবে এর বাইরেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নানা অভিযোগ আছে বাংলাদেশে। গেলো কয়েক মাসে এমন অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে গণপিটুনিতে।

১৮ই সেপ্টেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে এরকমই এক গণপিটুনির পর হাসপাতালে মারা যান বিশ্ববিদ্যলয়টির সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লা।

শামীম মোল্লার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারসহ নানা অভিযোগ থাকলেও তার পরিবারের প্রশ্ন–– আইনি পথে না গিয়ে কেন পিটিয়ে মারা হলো শামীমকে।

শামীম মোল্লার বাবা ইয়াজউদ্দিন মোল্লা বিবিসিকে বলছিলেন, তার ছেলেকে নির্যাতন না করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতো।

"ওখানে তো সবাই মারছে। আমি ভিডিও দেখিনি। কিন্তু শুনছি। যারা ভিডিও দেখছে তারা বলছে যে ছেলেটারে অনেক কষ্ট দিয়ে মারছে। পানি চাইছে, পানিও দেয় নাই।"

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনের অভিযোগ বহু পুরনো। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে এমন আশা করা হলেও বাস্তবে সেটা ঘটেনি।

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে দেখা যায়, ২০২৪ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে যে ২১টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ১২টিই হয়েছে গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই চার মাসে।

এর মধ্যে সাতটি ঘটনাই ঘটেছে যৌথবাহিনীর অধীনে। আর পুলিশের কাস্টোডিতে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন তিনজন।

যৌথবাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনা সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে গত সেপ্টেম্বরে, যখন দেশটির উত্তরের জেলা গাইবান্ধায় যৌথবাহিনীর অভিযানে আটক হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাসহ পাঁচজন।
Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post