বাংলাদেশে পালাবদলে যুক্তরাষ্ট্রের 'ডিপ স্টেটের' ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন, নাকচ করলেন ট্রাম্প
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে যুক্তরাষ্ট্রের 'ডিপ স্টেটের' ভূমিকার বিষয়ে নানা আলোচনা যে রয়েছে, তা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার রাতে ওয়াশিংটনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, "এতে আমাদের ডিপ স্টেটের কোনো ভূমিকা নেই।"
নরেন্দ্র মোদীর দুই দিনের ওয়াশিংটন সফরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর মার্কিন সফরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, শুল্ক, ভিসানীতি, ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় এসেছে।
ট্রাম্প-মোদীর বৈঠকে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের প্রসঙ্গ উঠতে পারে–– এমনটা ধারণা করা হচ্ছিলো।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। তাকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে তাকে ফেরত পাঠানোর দাবিও জোরালো করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর বাংলাদেশে সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়। এই সম্পর্কে উন্নতির কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন প্রেক্ষাপটে নরেন্দ্র মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে নানা আলোচনার সৃষ্টি হয়।
ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন করে বসেন ভারতীয় এক সাংবাদিক। তার প্রশ্নেই ছিল বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'ডিপ স্টেটের' ভূমিকার প্রসঙ্গ।বাংলাদেশ নিয়ে কী বলেছেন ট্রাম্প?
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ডিপ স্টেটের প্রসঙ্গ টেনে ভারতের ওই সাংবাদিক প্রথমে নরেন্দ্র মোদীর কাছে হিন্দিতে জানতে চান, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভারতের ভূমিকার বিষয়ে। এরপর ট্রাম্পের উদ্দেশে ইংরেজিতে প্রশ্ন করেন তিনি।
এরপর ওই সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রশ্ন রাখেন, "আপনি বাংলাদেশ বিষয়ে কী বলতে চান? কেননা আমরা দেখেছি এবং এটা স্পষ্ট যে, বাইডেন প্রশাসনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেট ক্ষমতার পরিবর্তনে জড়িত ছিল; এরপর জুনিয়র সরোসের ((মার্কিন বিনিয়োগকারী এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক আন্দোলনে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে) সঙ্গে বৈঠক করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। সুতরাং বাংলাদেশের বিষয়ে আপনার অভিমত কী?"
এর জবাবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা সরাসরি নাকচ করে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তিনি বলেন, "সেখানে আমাদের ডিপ স্টেটের কোনো ভূমিকা ছিল না। এটা এমন একটা বিষয়- যেখানে প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদী) দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।"
এরপর নরেন্দ্র মোদীর দিকে ইঙ্গিত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, স্পষ্ট করে বললে, ভারত সেখানে শতশত বছর ধরে কাজ করেছে, আর সেসব বিষয় তিনি পড়েছেন।
"তবে বাংলাদেশের বিষয় আমি প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দেব," বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বলার জন্য ইশারা দেন ট্রাম্প।
এরপর নরেন্দ্র মোদী জবাব দিতে গিয়ে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ভারতের অবস্থান তুলে ধরলেও বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
পরে সাংবাদিকরা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তিনি বলেন, "বাংলাদেশ নিয়ে যা বলতে পারি সেটা হলো, এ নিয়ে দুই নেতার মধ্যে আলোচনা হয়েছে।"
"বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী এবং ভারত এই পরিস্থিতিকে যেভাবে দেখছে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তার মতামত ও উদ্বেগের কথা (ডোনাল্ড ট্রাম্পকে) জানিয়েছেন।"
বিষয়টাকে আরও ব্যাখ্যা করে তিনি যোগ করেন, "আমরা আশা করি, বাংলাদেশের পরিস্থিতি সেই দিকে এগিয়ে যাবে, যেখানে তাদের সঙ্গে গঠনমূলক ও স্থিতিশীল উপায়ে আমাদের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে পারব। তবে সেই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী সেই সংক্রান্ত মতামতই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন।"
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রে 'ডিপ স্টেট' বলতে ছায়া রাষ্ট্রকে বোঝানো হয়। এটাকে সাধারণত সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কথিত গোপন নেটওয়ার্কও মনে করা হয়।
এই নেটওয়ার্কে এফবিআই এবং সিআইএ'র কর্মকর্তারাও থাকেন।
রাজনৈতিক সরকারের সমান্তরালে নিজেদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে স্বাধীনভাবে এই নেটওয়ার্ক কাজ করার চেষ্টা করে থাকে।যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস কিনবে ভারত
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দুই নেতার বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক, শুল্ক হ্রাসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
একদিকে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি পরিমাণে তেল ও গ্যাস এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক সামগ্রী কিনবে, তেমনই প্রাথমিক বাণিজ্য চুক্তি এবং শুল্ক নিয়ে অচলাবস্থা নিরসনের জন্য আলোচনা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বৈঠকের আগে ভারতে মার্কিন ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
পাশাপাশি, মার্কিন আমদানির ওপর শুল্ক আরোপকারী দেশগুলোতে 'পারস্পরিক শুল্ক' আরোপের জন্য রোডম্যাপও দিয়েছিলেন।
অর্থাৎ, যে দেশ মার্কিন আমদানির ওপর যেমন শুল্ক বসাবে, যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরই মধ্যে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
তিনি আমেরিকার দুই বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার কানাডা এবং মেক্সিকোর ওপরও শুল্কনীতি আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা ৩০ দিনের জন্য স্থগিত থাকার পরে মার্চ থেকে কার্যকর হতে পারে বলে বলা হয়েছে।
এদিকে, শুল্ক নিয়ে উত্তজনা কমাতে ভারত ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে।
সেই প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, "প্রধানমন্ত্রী মোদী সম্প্রতি ভারতের অন্যায্য এবং অত্যন্ত কঠোর শুল্ক কমানোর বিষয়ে ঘোষণা করেছেন, যা ভারতের বাজারে আমাদের প্রবেশাধিকারকে সীমাবদ্ধ করেছিল।"
তবে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তার বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির প্রাথমিক অংশগুলো নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করার সময় নির্বাচিত মার্কিন পণ্যতে শুল্ক হ্রাস এবং মার্কিন খামারজাত পণ্যগুলোর ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়ানোর ব্যাপারে দিল্লির সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে ওয়াশিংটন স্বাগত জানাচ্ছে।"অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ২.০ মেয়াদে শুল্কনীতিকে 'স্বাগত' জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী।
পাশাপাশি, তিনি জানিয়েছেন, মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমাতে, সামরিক যুদ্ধবিমান কিনতে এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী নথিহীন ভারতীয় নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ভারত প্রস্তুত রয়েছে।
মার্কিন মুলুক থেকে তেল ও গ্যাস ভারতে রফতানির বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, "ওদের (ভারতের) এটা প্রয়োজন এবং আমাদের কাছে তা রয়েছে।"
২০৩০ সালের মধ্যে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য দ্বিগুণ করতে চায় দিল্লি। পরমাণু শক্তির বিষয়ে দীর্ঘ পরিকল্পিত সহযোগিতা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে আলোচনা হলেও কিছু 'চ্যালেঞ্জ' রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য বলেছেন, "আমরা ভারতকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান দেওয়ার পথও প্রশস্ত করছি।"
পরে মি. মিশ্রি বলেছেন, "এফ-৩৫ চুক্তি এই মুহূর্তে একটা প্রস্তাব ছিল মাত্র, এর কোনও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া চলছে না।"
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হোয়াইট হাউসও এই বিষয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।
অন্যদিকে মি. মিশ্রি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের জ্বালানি সংক্রান্ত আমদানির পরিমাণ ১৫০০ কোটি বিলিয়ন ডলার থেকে ২৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে ভবিষ্যতে।
অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত নেবে ভারত
নথিহীন অভিবাসীদের কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে নথিহীন শতাধিক ভারতীয় অভিবাসীদের সামরিক বিমানে করে ফেরত পাঠানো এবং যাত্রার সময় তাদের হাতকড়া এবং পায়ে বেড়ি পরানো নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল ভারতে।
ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর বৈঠকে স্থান পেয়েছে অভিবাসন ইস্যু। জানা গেছে, এই বিষয়ে ভারতের কাছ থেকে আরও সাহায্য চান ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রে যেমন ওয়ার্ক ভিসাধারী প্রযুক্তি-সহ অন্যান্য সেক্টরে কাজ করা দক্ষ কর্মীরা রয়েছেন, তেমনই বিরাট সংখ্যায় অবৈধ অভিবাসীও রয়েছে বলে অভিযোগ।
অভিবাসন ইস্যুতে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা আরও মজবুত করে অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচার মোকাবিলা করতে সম্মত হয়েছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র।ট্রাম্প কী চাইছেন?
দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ঘোষণা এবং সদ্য ঘোষিত শুল্কনীতি সংক্রান্ত দিক নির্দেশিকা থেকে এই বিষয়টা আরও একবার স্পষ্ট যে তার কাছে অগ্রাধিকার পাবে নিজের দেশ।
যে সব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বেশি আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে, তাদের সঙ্গে কোনো রকম 'আপস' করবে না তার প্রশাসন। ভারতও সেই তালিকায় রয়েছে।
বিষয়টা আঁচ করেই অবশ্য মোটরসাইকেলসহ একাধিক ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাস করেছিল দিল্লি। পাশাপাশি, ভারতের সঙ্গে যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে সেটাও মোকাবিলা করতে চান মি. ট্রাম্প।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও তার ইঙ্গিত মিলেছে। ভারতকে আরও বেশি পরিমাণে তেল ও গ্যাস আমদানি এবং সামরিক সরঞ্জাম কেনার কথা বলার বিষয়টি ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির প্রতিফলন।
নরেন্দ্র মোদী অবশ্য বলেছেন, "একটা বিষয় আমি গভীরভাবে প্রশংসা করি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকে শিখেছি যে, তিনি জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখেন। তার মতো আমিও ভারতের জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখি।"
'ভালো বন্ধু' হিসাবে পরিচিত ট্রাম্পও অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা করেছেন এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই লক্ষ্য চীনকে মোকাবিলা করা। এছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিতে যৌথ উৎপাদন শুরু করতে সম্মতি প্রকাশ করেছেন তারা।
পাশাপাশি অভিবাসন ইস্যুতেও নিজের কঠোর অবস্থানের কথা আরও একবার স্পষ্ট করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
আগামী সময়ে ভারত এসব ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেয় এবং কতটা 'নমনীয়' হয় সেদিকেই নজর থাকবে সবার।
Post a Comment